হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজার শরীফ বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অন্যতম একটি পবিত্র স্থান। হযরত শাহজালাল (রহ.) বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইসলাম প্রচারক ও অলী ছিলেন। তার নামের সাথে জড়িয়ে আছে ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিলেট বিজয় করেন এবং সেখানে ‘ইসলাম’ প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।এই মাজারটি সিলেট শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, এবং হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার বাংলাদেশের অন্যতম পবিত্র স্থান।
হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজার শরীফ:
হজরত শাহজালাল (রহ.) ইন্তেকাল করেন। । । এটি শুধু বাংলাদেশ নয় বরং, ১৩৪৬ সালে হজরত শাহজালাল (রহ.) ইন্তেকাল করেন। সিলেট শহরের দরগাহ এলাকায় তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে সমাহিত করা হয়।এটি হজরত শাহজালাল মাজার শরীফ নামে বর্তমানে পরিচিত। শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয় এটি উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান ‘সুফি’ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
হযরত শাহজালাল (রহ.)প্রাথমিক জীবন:
১২৯১ সালের ২৪ শে রজব (হিজরি ৬৯১) সনে, বর্তমান ইরাকের নিকটবর্তী “নেসাবুর” এলাকায় হযরত শাহজালাল (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হযরত শাহ আহমদ (রহ.) এবং মাতার নাম ছিল শাহ বেগম (রহ.)। তিনি ছোট থেকেই অত্যন্ত ধার্মিক, দয়ালু এবং সতীশ্বরী ছিলেন। আল্লাহর প্রতি অগাধ ভালবাসা এবং ইসলামিক জ্ঞান অর্জনের প্রবণতা দেখা গিয়েছিল সেই ছোট থেকে। শিক্ষার সূচনা হয় তাঁর পিতা-মাতার কাছে। পরে তিনি, বিভিন্ন মাদরাসায় ইসলামি শিক্ষা লাভ করেন।
ইসলাম গ্রহণের পরিসমাপ্তি :
হযরত শাহজালাল (রহ.) ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর প্রথমে, নিজের আধ্যাত্মিক জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। বহু আলেম ও মুজতাহিদদের নিকট থেকে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন তিনি। তার আধ্যাত্মিক সাধনা তাকে নতুন মাত্রায় পূর্ণতা প্রদান করে। একসময় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য ভ্রমণ করতেন এবং ইসলাম প্রচার করতেন।পরবর্তীতে তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য বাংলাদেশের সিলেটে আসেন। তার আশ্রয়ে সিলেটের হাজার হাজার লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি সিলেটে আশ্রয় নেওয়ার পরবর্তী সময়ে সিলেটের জনজীবনে এক গভীর পরিবর্তন আসে।
সিলেটের প্রতি তার অবদান অবদান:
হযরত শাহজালাল (রহ.) সিলেট অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে বহু মানুষকে ধর্মীয় শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। সিলেট শহরের সন্নিকটে আজও তাঁর নামাঙ্কিত ‘শাহজালাল দরগা’ একটি ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক স্থান হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্ত তাঁর কাছে এসে আত্মবিশ্বাস লাভ করেন, দোয়া করেন, এবং তাঁর ঐতিহাসিক জীবনের প্রেরণায় আলোকিত হন।
সাহসী ও একনিষ্ঠ কর্মী:
হযরত শাহজালাল (রহ.) ছিলেন একজন মহৎ মুক্তিযোদ্ধা, তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার এবং অন্যায় প্রবণতাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোরভাবে লড়াই করেছিলেন। একদিকে তিনি ছিলেন ইসলামের প্রচারক, অন্যদিকে তাঁর নেতৃত্বে বহু মানুষ বিভিন্ন সামাজিক অন্যায় থেকে মুক্তি লাভ করেছিলেন। তাঁর অধীনে বহু শিষ্য ও অনুগামী ধর্মের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
তার জীবন শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি সামাজিক অধিকার, সাম্য, এবং মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। তাঁর নেতৃত্বে সিলেটে মুসলিম সমাজ একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তোলতে সক্ষম হয়েছিল।
হযরত শাহজালাল (রহ.) অলৌকিক ক্ষমতা:
জীবনে বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ করেছিলেন, যা তাঁর আধ্যাত্মিক মহিমা ও পরকালের প্রতি গভীর বিশ্বাসের প্রকাশ। তাঁর কাছে বহু অলৌকিক শক্তির প্রকাশ ঘটেছে, যেমন তিনি “প্রার্থনার” মাধ্যমে অসুস্থদের সুস্থ করে তুলতেন। বহু মানুষকে তিনি আধ্যাত্মিক শান্তি প্রদান করেছেন। তাঁর মাজারে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের রহস্যময় ঘটনা এখনো ঘটে।
বিশ্বাস করা হয় যে তিনি তাঁর জীবনে ইসলাম ধর্মের প্রচারের জন্য অগণিত অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মাজারে গিয়ে বহু মানুষ অসংখ্য অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছেন এবং জীবনের নানা সমস্যার সমাধান পেয়েছেন।
আজকের সমাজে তাঁর অবদান:
হযরত শাহজালাল (রহ.) এর অবদান শুধু মাত্র সিলেট অঞ্চলে নয়, বরং পুরো বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর জীবনের শিক্ষা আমাদের কাছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নিয়ে আসে:
১. আধ্যাত্মিক উন্নতি: শাহজালাল (রহ.) আমাদের শিখিয়েছেন, একজন মুসলিমের জন্য আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ হল আল্লাহর প্রতি সঠিক বিশ্বাস ও সঠিক পথ অনুসরণ করা। জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের নীতি ও “আদর্শ” মেনে চলা।
২. মানবিক মূল্যবোধ: তাঁর জীবন আমাদের শিখিয়েছে মানুষের জন্য কাজ করা, অসহায়দের সাহায্য করা এবং সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন।
মাজারে যা দেখতে পাবেন
হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজার দর্শনার্থীদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। এখানে দর্শনার্থীরা দেখতে পারেন:
হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজার শরীফ :
- এটি মাজারের প্রধান আকর্ষণ যেখানে শাহজালাল (রহ.)-এর কবর রয়েছে। প্রতিদিন হাজারো মানুষ এখানে দোয়া করতে আসেন।
১. মাজারের পুকুর ও রহস্যময় গজার মাছ:
- এই পুকুরে বিরল প্রজাতির গজার মাছ রয়েছে, যা শাহজালাল (রহ.)-এর কেরামতির নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়।
২. শাহজালালের ব্যবহার করা তরবারি ও অন্যান্য জিনিসপত্র:
- মাজার সংলগ্ন একটি স্থানে তাঁর ব্যবহৃত তরবারি, পোশাক ও অন্যান্য দ্রব্য সংরক্ষিত আছে।
৩. দরগাহ মসজিদ:
- মাজারের পাশে অবস্থিত এই মসজিদে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ নামাজ আদায় করেন।
৪. মাজারের আশেপাশের সুফি পরিবেশ:
- এখানে গেলে এক আধ্যাত্মিক শান্তি অনুভব করা যায়, যা দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে।
৫. সালামত খানকার গম্বুজ:
- এটি মাজারের নিকটে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক গম্বুজ, যা মাজারের পরিবেশকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তোলে।
৬. মাজারের বারান্দা ও তেলাওয়াতের স্থান:
- এখানে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত ও জিকির অনুষ্ঠিত হয়, যা আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি করে।
৭. শাহজালালের অনুসারীদের কবরস্থান:
- মাজার সংলগ্ন এলাকায় তাঁর অনুসারীদের কবর রয়েছে, তাঁর সঙ্গে ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন।
অবস্থান
হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজার সিলেট বিভাগের সিলেট জেলার সদর উপজেলার দরগাহ মহল্লায় অবস্থিত। এটি সিলেট শহরের কেন্দ্রস্থলে, সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে এবং ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে বহু দর্শনার্থী এই মাজার পরিদর্শনে আসেন।
ঢাকা থেকে কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে সিলেটে যাওয়ার জন্য কয়েকটি ভ্রমণ পদ্ধতি রয়েছে:
১. বিমান:
- ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট রয়েছে।
- বিমান ভাড়া: ৩,৫০০ থেকে ১০,০০০ টাকা (এয়ারলাইন্স ও সময়ভেদে)।
- ফ্লাইট সময়: প্রায় ৪৫-৬০ মিনিট।
২. ট্রেন:
- ঢাকা থেকে সিলেটগামী কয়েকটি আন্তঃনগর ট্রেন রয়েছে, যেমন পারাবত এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস, কালনী এক্সপ্রেস।
- ট্রেনের সময়: সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ট্রেন পাওয়া যায়।
- ট্রেন ভাড়া: সাধারণত ৩২০-১৫০০ টাকা (ক্লাস অনুযায়ী)।
- যাত্রার সময়: প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা।
৩. বাস:
- ঢাকা থেকে সিলেটগামী এসি ও নন-এসি বাস রয়েছে। যেমন: শ্যামলী পরিবহন, হানিফ, সৌদিয়া, গ্রিন লাইন, এনআর পরিবহন ইত্যাদি।
- বাস ভাড়া: ৫০০-২০০০ টাকা (এসি বা নন-এসি বাসের ভিত্তিতে)।
- যাত্রার সময়: প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা।
৪. ব্যক্তিগত গাড়ি:
- ঢাকা থেকে সরাসরি সিলেট পর্যন্ত নিজস্ব গাড়ি বা ভাড়ায় গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়।
- গাড়ি ভাড়া: ৮০০০-১৫০০০ টাকা (গাড়ির ধরন ও সুবিধার উপর নির্ভর করে)।
- যাত্রার সময়: প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা।
থাকার ব্যবস্থা ও হোটেল ভাড়া
সিলেট শহরে থাকা ও খাওয়ার জন্য বিভিন্ন মানের হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। পর্যটকদের সুবিধার্থে এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য থাকার স্থান দেওয়া হলো:
১. রোজভ্যালি রিসোর্ট – উচ্চমানের সুবিধাসম্পন্ন রিসোর্ট, এখানে থাকার খরচ ৪০০০ থেকে ১০০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
২. নিরিবিলি রিসোর্ট – শান্ত ও মনোরম পরিবেশে, ভাড়া ৩০০০ থেকে ৭০০০ টাকা।
৩. হোটেল স্টার প্যাসিফিক – এটি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সহ একটি স্বনামধন্য হোটেল, যেখানে থাকার খরচ ২৫০০ থেকে ৬০০০ টাকা।
৪. হোটেল ফরচুন গার্ডেন – এখানে মধ্যমানের বাজেটে থাকা যায়, যার ভাড়া ২০০০ থেকে ৫০০০ টাকা।
৫. হোটেল হিলটাউন – স্বল্প বাজেটের পর্যটকদের জন্য আদর্শ হোটেল, ভাড়া ১০০০ থেকে ৩০০০ টাকা।
৬. সিটি ইন হোটেল & রিসোর্ট – বিলাসবহুল পরিবেশ ও মানসম্মত সেবা, এখানে ভাড়া ৫০০০ থেকে ১২০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
৭. সাধারণ বোর্ডিং হাউস – যারা স্বল্প খরচে মধ্যে থাকতে চান, তারা ৫০০-১৫০০ টাকার বোর্ডিং হাউসে থাকতে পারেন।
“এছাড়াও আশেপাশে অনেক হোটেল রয়েছে, আপনাদের চাহিদা অনুযায়ী পেয়ে যাবেন”
হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজারের নিয়ম:
১. পরিষ্কার পোশাক পরা: মাজারে প্রবেশের আগে অবশ্যই ধর্ষণার্থীদের পরিষ্কার ও পবিত্র পোশাক পরা উচিত। যেহেতু এটি আধ্যাত্মিক শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ।
২. মাজারে প্রবেশের সময় সন্মান প্রদর্শন: মাজারে প্রবেশ করার আগে সম্মান দেখানো এবং শান্তভাবে প্রবেশ করা উচিত। এখানে অশালীন আচরণ বা উচ্চশব্দে কথা বলা নিষেধ।
৩. দোয়া করা: মাজার আসার লোকজন সাধারণত আল্লাহর কাছে সাহায্য এবং দোয়া করতে আসেন। এখানে মানুষজন ব্যক্তিগত প্রার্থনা বা মঙ্গল কামনা করে থাকে।
৪. কবুতর মুক্তি দেওয়া: এই মাজারে একটি পুরনো রীতি হল কবুতর ছেড়ে দেওয়া, এটি শান্তি ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়
৫. মাজারের পাশে কিছু শিষ্টাচার পালন করা: মাজারের আশেপাশে কোন অশালীন আচরণ বা অশান্তির সৃষ্টি করা যাবেনা যেহেতু, স্থানটি আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক তাই সম্মান প্রদর্শন করা জরুরী।
৬. মাজারের পানি বা মাটি গ্রহণ না করা: তোমাদের মাটি বা পানি গ্রহণ করা নিষিদ্ধ কারণ, এর মাধ্যমে “আধ্যাত্মিক” অশুদ্ধতা সৃষ্টি করতে পারে।
মাজারের মাটি বা পানি গ্রহণ করা সাধারণত নিষিদ্ধ, কারণ এটি আধ্যাত্মিক অশুদ্ধতা সৃষ্টি করতে পারে।
! এই নিয়মগুলি মাজারের প্রতি সন্মান এবং আধ্যাত্মিক শুদ্ধতার ধারণা নিয়ে পালিত হয় !
মন্তব্য
শাহজালাল রহমতুল্লাহি শুধুমাত্র একজন সুফি সাধক ছিলেন না, বরং সে ছিলেন একজন মহান ইসলাম প্রচারক, তাঁর জীবন ও শিক্ষা আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে তোলে। প্রতিবছর এই মাজারটিতে অসংখ্য মানুষ আসেন, দোয়া করেন এবং হযরত শাহজালাল (রহ.) এর জীবন থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেন ।
➡️ আরও ভ্রমণ গাইড পড়ুন: সিলেট বিভাগের সকল তথ্য
Leave a Reply