বরিশাল বিভাগের ইতিহাস সাহসী সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের এক অনন্য দলিল, যা বাংলার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বরিশাল বিভাগ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এলাকা। প্রচুর নদ-নদীর কারণে একে “বাংলার ভেনিস” বলা হয়। বরিশাল তার জলপথ, সবুজ শ্যামল প্রকৃতি, এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত।
বরিশাল বিভাগের ইতিহাস
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন বিভাগ বরিশাল বিভাগ । এই বিভাগের ইতিহাস অনেক প্রাচীন, যা বিভিন্ন শাসনব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বরিশাল
বরিশাল অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকেই নদীবাহিত অঞ্চলের অংশ ছিল। ধারণা করা হয়, এটি গুপ্ত, পাল ও সেন শাসনামলের অধীনে ছিল। ১২শ শতাব্দীতে সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন এই অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করেন।
মোগল ও ব্রিটিশ শাসনকাল
১৫৭৬ সালে মোগলরা বাংলার শাসনভার গ্রহণ করলে বরিশাল অঞ্চলও তাদের শাসনের অধীনে চলে আসে। মোগলদের সময়ে এখানে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে এবং কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি সাধিত হয়। ১৭৫৭ সালের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হলে বরিশালকে একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়।
ব্রিটিশ শাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন
বরিশাল অঞ্চলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় বরিশালে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং এখানে স্বদেশী আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলন, সশস্ত্র বিপ্লবী কার্যক্রম এবং ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে বরিশালবাসী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বরিশাল
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সাথে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বরিশাল শহর ও আশপাশের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন যুদ্ধ সংঘটিত হয়, বিশেষ করে গৌরনদী, বাকেরগঞ্জ ও মেহেন্দিগঞ্জ এলাকায় তীব্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বরিশাল শত্রুমুক্ত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়।
বর্তমান বরিশাল বিভাগ
১৯৯৩ সালে বরিশালকে পূর্ণাঙ্গ বিভাগ ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে এটি ছয়টি জেলা নিয়ে গঠিত – বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা এবং ঝালকাঠি। বরিশাল বিভাগ কৃষি, নদীপথ ও পর্যটনের জন্য বিখ্যাত। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবনের দক্ষিণাংশ এবং অসংখ্য নদী-খাল এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
বরিশাল বিভাগের জেলা – Barishal Divition All Distric:
বরিশাল বিভাগে মোট ৬টি জেলা রয়েছে:
- বরিশাল – বিভাগীয় রাজধানী ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র।
- পটুয়াখালী – কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের জন্য পরিচিত।
- ভোলা – বাংলাদেশের বৃহত্তম দ্বীপ জেলা।
- ঝালকাঠি – ভাসমান পেয়ারা বাজারের জন্য বিখ্যাত।
- পিরোজপুর – বনজ সম্পদ ও নদী-বেষ্টিত এলাকা।
- বরগুনা – উপকূলীয় অঞ্চল ও সুন্দরবনের একটি অংশ এখানে অবস্থিত।
অর্থনীতি ও কৃষি
বরিশালের অর্থনীতি মূলত কৃষি, মৎস্যচাষ ও ব্যবসা নির্ভর। এখানে প্রচুর পরিমাণে ধান, পেয়ারা, সুপারি ও নারকেল উৎপাদিত হয়। মৎস্যশিল্পও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানকার নদী ও বঙ্গোপসাগরের সংযোগ রয়েছে। বর্তমানে শিল্প ও ব্যবসার প্রসারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বরিশাল বিভাগের দর্শনীয় স্থান – Barisal Historical Place:
বরিশাল বিভাগ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদ-নদী, সমুদ্র সৈকত এবং ঐতিহাসিক স্থানের জন্য বিখ্যাত। এখানে পর্যটকদের জন্য অনেক আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে।
১. কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত (পটুয়াখালী)- Kuakata Sea Beach:
- কুয়াকাটা বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর সমুদ্র সৈকত, যা “সমুদ্র কন্যা” নামে পরিচিত।
- এটি একমাত্র সৈকত, যেখানে দাঁড়িয়ে একসাথে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়।
- এখানে রয়েছে রাখাইন সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ মন্দির, জঙ্গল, এবং কুয়াকাটা ইকো পার্ক।
২. দুর্গাসাগর দীঘি (বরিশাল)- Durga Sagor Barishal:
- এটি বরিশালের বৃহত্তম দীঘি, যা ১৮৭৩ সালে রাজা শিবনারায়ণ নির্মাণ করেন।
- শীতকালে এখানে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে, যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
- নৌকায় চড়ে দীঘির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
৩. ভাসমান পেয়ারা বাজার (ঝালকাঠি) – Vasoman Peyara Bazar:
- বাংলাদেশের একমাত্র ভাসমান বাজার, যা থাইল্যান্ডের ভাসমান বাজারের মতো।
- বর্ষাকালে এটি সবচেয়ে ব্যস্ত থাকে, যখন পেয়ারা, আমড়া, কলা এবং অন্যান্য ফল নৌকায় করে বিক্রি হয়।
- এটি মূলত সুযোগঞ্জ, ভীমরুলি ও আটঘর কুড়িয়ানা অঞ্চলে অবস্থিত।
৪. লেবুর চর (ভোলা)- Lebur Chor:
- এটি একটি অপরূপ দ্বীপ, যা মেঘনা নদীর বুকে গড়ে উঠেছে।
- এখানে গেলে নদীর বয়ে যাওয়া বিশাল ঢেউ, সুন্দর প্রকৃতি ও নৌকা ভ্রমণ উপভোগ করা যায়।
- এটি বিশেষ করে প্রকৃতিপ্রেমী ও ফটোগ্রাফারদের জন্য উপযুক্ত স্থান।
৫. শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত (পটুয়াখালী) – Shuvo Sondha Sea Beach
- কুয়াকাটার নিকটবর্তী আরেকটি সুন্দর সৈকত, যেখানে বালিয়াড়ি ও নারিকেল গাছের সারি পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
- এখানে বসে সাগরের গর্জন ও ঢেউয়ের শব্দ উপভোগ করা যায়।
৬. ফাতরার চর (পটুয়াখালী) – Fatrar Char Kuakata
- এটি কুয়াকাটার কাছে একটি মনোরম পর্যটন কেন্দ্র ও বনাঞ্চল।
- এখানে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী ও সবুজ প্রকৃতি দেখা যায়।
- ফাতরার চরে বোট রাইডিং এবং ক্যাম্পিং করা সম্ভব।
৭. সুন্দরবন (বরগুনা অংশ) – Sundarban
- বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের একটি অংশ বরগুনায় অবস্থিত।
- এখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, কুমির, বানর সহ নানা বন্যপ্রাণী দেখা যায়।
- পর্যটকরা নৌকায় করে বনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।
৮. মনসা মন্দির (ভোলা) – Monosa Mandir
- এটি ভোলার একটি ঐতিহাসিক মন্দির, যা মনসা দেবীর পূজা উপলক্ষে প্রসিদ্ধ।
- প্রতিবছর এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বড় উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
৯. সোনার চর (পটুয়াখালী) – Shonar Chor Patuakhali :
- এটি বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী একটি অনিন্দ্য সুন্দর দ্বীপ।
- সোনারচর বিশেষভাবে পরিচিত বন্যপ্রাণী ও নিরিবিলি পরিবেশের জন্য।
- এটি প্রকৃতিপ্রেমী ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য আদর্শ স্থান।
১০. লাকুটিয়া (বরিশাল) – Lakutiya Barishal:
- এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা, যা ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন।
- বর্তমানে এটি একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে পরিচিত।
১১. গুঠিয়া বড় মসজিদ (বরিশাল) -Guthia Mosque:
- বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর মসজিদ, যা ‘বায়তুল আমান জামে মসজিদ‘ নামেও পরিচিত।
- এখানে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব সমন্বয় রয়েছে।
বরিশালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য – Barisal Famous Even:
বরিশাল বিভাগে প্রতি বছর বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
- বার্ষিক রাস উৎসব (ভোলা): এটি একটি ঐতিহ্যবাহী হিন্দু উৎসব, যা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা উদযাপন করে।
- পূষ মেলা: বরিশালের বিভিন্ন স্থানে শীতকালে এই মেলা হয়, যেখানে লোকসংগীত, যাত্রাপালা ও হস্তশিল্প প্রদর্শিত হয়।
- নদী উৎসব: নদী প্রধান অঞ্চল হিসেবে বরিশালে নানা নদী কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
- পান্থনৃত্য ও যাত্রা পালা: এটি বরিশালের অন্যতম জনপ্রিয় লোকনৃত্য ও নাট্যধারা।
বরিশাল বিভাগ তার অসংখ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান, নদী, দ্বীপ, ঐতিহাসিক স্থান এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। যারা প্রকৃতি, সমুদ্র ও ঐতিহ্য ভালোবাসেন, তাদের জন্য বরিশাল বিভাগ একটি স্বর্গরাজ্য।
Leave a Reply